জনমনে আতঙ্ক
খুলনায় এক মাসে ৮ খুন

খুলনা এখন লাশের নগরী। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও খুন, হামলা আর রহস্যজনক মৃত্যুর খবর মিলছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে শহর কিংবা গ্রাম সবখানেই ছড়িয়ে পড়েছে অস্থিরতা। এক মাসে খুন হয়েছে আটজন, উদ্ধার হয়েছে চারটি লাশ, আর প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়েছেন ডজনখানেক মানুষ। তবুও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশ মামলা নেয়, গ্রেপ্তার দেখায়, আর ঘটনার হিসাব কষে কাগজে-কলমে। কিন্তু বাস্তবে অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে অদৃশ্য, আর জনপদে ছড়াচ্ছে আতঙ্ক।
গুলিতে মানুষ খুন হচ্ছে, আবার কেউ কুপিয়ে বা পিটিয়ে মরছে। হত্যার ধরন পাল্টাচ্ছে, কিন্তু থামছে না। গত ১১ সেপ্টেম্বর একসঙ্গে আট থানার ওসি বদলির পরও কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন আসেনি। বরং সাধারণ মানুষের অভিযোগ, পুলিশ শুধু সংখ্যার খাতা পূরণ করছে, মাঠে তাদের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। দুর্বৃত্তরা যখন-তখন খুন করছে, গুলি ছুঁড়ছে, গণপিটুনি দিচ্ছে, আর প্রশাসন বলছে, তারা কাজ করছে।
অভ্যুত্থানের আগে খুলনার মাদক সিন্ডিকেট ছিল এক ছাতার নিচে। এখন ভেঙে গেছে সেই নিয়ন্ত্রণ, ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আধিপত্য আর মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কিশোর গ্যাং, যারা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। খুলনা যেন হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী।
খুলনা জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য বলছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে রূপসা উপজেলার রাজাপুর গ্রামে পারিবারিক কলহে স্বামীর দায়ের কোপে খুন হন গৃহবধূ পারভীন বেগম। একই দিন রাত ১১টার দিকে জয়পুর এলাকায় একটেল টাওয়ারের পেছনে মাস্টারবাড়ির গেটের কাছে বি-কম্পানির সক্রিয় সদস্য ইমরান হোসেন মানিককে (৩৪) গুলি করে হত্যা করা হয়।
৮ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় দাকোপের সুতারখালী ইউনিয়নের গুনারী এলাকায় পূর্বশত্রুতার জেরে রেখা রানী মণ্ডল (৪২) নামে এক নারী খুন হন। ২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে ফুলতলার জামিরা বাজারে চাঁদাবাজির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বাড়ি থেকে ধরে এনে গণপিটুনিতে মারা যান আলমগীর হোসেন রানা (৩৮)। ২৩ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর কেডিএ ময়ূরী আবাসিক এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনের বাথরুম থেকে দিনমজুর নারী মনোয়ারা বেগম সুপ্তির গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে নগরীর লবণচরা থানার মাটির ডিবির সামনে থেকে অজ্ঞাত এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই রাত ৯টার দিকে রূপসার জাবুসা চৌরাস্তার মোড়ের কাছে আইডিয়াল কোম্পানির পুকুর থেকে হাত-পা বাধা অজ্ঞাত এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৩০ সেপ্টেম্বর রাত আড়াইটার দিকে দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় নিজ ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় তানভীর হাসান শুভকে (২৮)।
একই সময়ে প্রতিপক্ষের হামলায় অন্তত ১১ জন আহত হন। ৯ সেপ্টেম্বর ডুমুরিয়ায় গরু চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হন মনির শেখ (৪৩), টিপু মুন্সি (৪৮) ও রবিউল ইসলাম (৩৮)। ১২ সেপ্টেম্বর খালিশপুর বাজার রোডে যুবদল নেতা মাসুদ হোসেনকে (৪৫) কুপিয়ে জখম করা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর রূপসায় জেলা বিএনপি নেতা আবু হোসেন বাবুর বাড়িতে বোমা হামলা ও গুলি ছোঁড়া হয়।
১৮ সেপ্টেম্বর পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হন হাবিব শেখ। ১৯ সেপ্টেম্বর সদর থানার বাগমারা এলাকায় দায়ের আঘাতে জখম হন শাহাদাত হোসেন। ২২ সেপ্টেম্বর হরিণটানায় চুরি সন্দেহে পিতা-পুত্রকে মারধর করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে অনিক নামে এক যুবককে গুলি করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর সোনাডাঙ্গায় ছুরিকাঘাতে আহত হন রিয়াজ (২৩)। ২৮ সেপ্টেম্বর হাজী মালেক কলেজ এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিক গ্রুপের সদস্য মুন্না গুলিবিদ্ধ হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর রূপসার ইস্টার্ন জুট মিলে ধারালো অস্ত্রাঘাতে গুরুতর আহত হন ফয়সাল (২৬)।
এ সময়ের মধ্যে আরও চারজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরমধ্যে ১ সেপ্টেম্বর বটিয়াঘাটা কাজীবাছা নদী থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মরদেহ, ১৪ সেপ্টেম্বর সদর থানার সামনে স্টার হোটেলের কক্ষ থেকে তৌহিদুর রহমান তুহিনের (৩৫) লাশ, ২৩ সেপ্টেম্বর শিপইয়ার্ড পল্টুনের কাছে ভেসে থাকা অজ্ঞাত যুবকের লাশ এবং ২৫ সেপ্টেম্বর দাকোপের চুনকুড়ি খেয়াঘাট থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক নারীর (৪০) লাশ উদ্ধার করা হয়।
কেএমপি পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মো. রাশিদুল ইসলাম খান বলেন, খুলনায় যত হত্যা বা হামলার ঘটনা ঘটেছে, এর বেশিরভাগের নেপথ্যে মাদক। আমরা এগুলো নিয়ন্ত্রণে এবং আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে যাচ্ছি।
ভিওডি বাংলা/ এমপি