প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ বাংলাদেশ নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক : রেজাউল করীম


ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দলের আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতী রেজাউল করীম বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং প্রধান উপদেষ্টার গতকালের ভাষণ আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের পথে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। জুলাই ঘোষণাপত্র এবং প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ আমরা গভীর পর্যাবেক্ষণ করেছি এবং তারই ভিত্তিতে আজকে দলের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য এই সংবাদ ব্রিফিং আহবান করা হয়েছে।
বুধবার (৬ আগস্ট) ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লিখিত বক্তব্য রাখেন দলের আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতী রেজাউল করীম।
তিনি বলেন, শুরুতেই জুলাই অভ্যুত্থানে জীবন উৎসর্গকারী বীর যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের শোকাহত পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত সকলের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ১৮৫৭ সাল থেকে শুরু করে ৪৭ ও ৭১ এর সকল যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করছি।
চরমোনাই পীর বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আমাদের প্রথম পর্যাবেক্ষণ হলো, ঘোষণার আগে এটা আমরা দেখি নাই। জাতির এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল উপস্থাপনার আগে থেকে না জেনে উপস্থিত থেকে তাতে সমর্থন জানাতে হয়েছে এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর ছিলো। তারপরেও প্রত্যাশিত দিনে জুলাই ঘোষণাপত্র পঠিত হয়েছে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ। তবে জুলাই ঘোষণাপত্রে ৭১, ৭৫ এর সাত নভেম্বর ও ৯০ এর আন্দোলন সহ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হলেও আমাদের স্বাধীনতার প্রথম অধ্যায় ৪৭ এবং পতিত ফ্যাসিস্ট আমলের সবচেয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড শাপলা হত্যাকান্ড, পিলখানা হত্যাকান্ড ও আলেম-উলামাদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের কথা উল্লেখ না করে ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন মনে করে, এতে ইতিহাসের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে।
রেজাউল করীম বলেন, ঘোষণাপত্রের বিভিন্ন ধারায় হাসিনা ও আওয়ামী অপকর্মের উল্লেখ আছে। ১৭ তম ধারায় জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের উল্লেখ আছে। কিন্তু কোথায়ও ফ্যাসিবাদের দোসর রাজনৈতিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির উল্লেখ নাই। ইসলামী আন্দোলন মনে করে এটা ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের পথ খুলে দেবে।
তিনি বলেন, ঘোষণাপত্রের ধারা ১৯ এ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলায় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রত্যয় ও প্রয়োগের রাজনৈতিক ও আইনী বৈধতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উল্লেখ করা হলেও ধারা ২৫ এ জনতা ও তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন, মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ নির্মাণের প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারকে পরবর্তী জাতীয় সংসদের ওপরে ন্যাস্ত করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করে এর মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। একই সাথে ধারা ২৭ এ জুলাই অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতিকে “উপযুক্ত” শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আপেক্ষিক করে পরবর্তী সরকারের ওপরে ন্যাস্ত করে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। তার ভাষণ সুলিখিত এবং তার পাঠ আবেগ মিশ্রিত। ভাষণে সরকারের নানা সাফল্যের কথা এসেছে এবং আগামী ফেব্রুয়ারি-২৬ এ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা এসেছে। এখানে আমাদের পর্যাবেক্ষণ হলো, জুলাই সনদ এখনো না হওয়া আমাদেরকে সংস্কার নিয়ে অনিশ্চয়তায় নিক্ষেপ করেছে। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক যাত্রাও শুরু হয়েছে। তিনিও বারংবার বলছেন, ফেব্রুয়ারি দুরে নয়। কিন্তু সংস্কারের প্রতিশ্রুতি সম্বলিত জুলাই সনদ এখনো হয় নি। সংস্কারের রুপরেখা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয় নাই। জনতার প্রত্যাশা অনুসারে সংস্কারকে স্থায়ী করার ব্যবস্থা না নিয়ে এখনতক সংস্কারকে পরবর্তী সরকারের ওপরে ন্যাস্ত রেখে পুরো সংস্কার কার্যক্রমকে অনিশ্চিত করে রাখা হয়েছে। আমরা পরিস্কার করে বলতে চাই, অধ্যাদেশ জারি বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনীভিত্তি তৈরী করতে হবে এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতেই জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের আমীর বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সুদীর্ঘকাল থেকে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের দাবী জানিয়ে আসছে। অভ্যুত্থানের পরে পিআরের পক্ষে ব্যাপক জনমত গঠন হয়েছে এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমরা বারংবার উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন আয়োজনের জন্য সংস্কার কমিশনে কথা বলেছি, লিখিত জানিয়েছি। এর যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিৎ ছিলো পিআর নিয়ে সংস্কার কমিশনে এজেন্ডা রাখা। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনে আমাদের বারংবার প্রচেষ্টা সত্যেও নিম্নকক্ষে পিআর নিয়ে কোন এজেন্ডাই রাখা হয় নাই। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পরে রাজনৈতিক সংস্কার সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পিআর নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই নির্বাচনের মাস নির্ধারণ করা জনদাবীর প্রতি স্পষ্টত উপেক্ষা করা। আমরা নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহবান জানাবো, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এই জনদাবীর বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কার্যক্রম শুরু করবেন না। একই সাথে ঐকমত্য কমিশনের প্রতি আহবান জানাবো, অতিদ্রুত পিআর নিয়ে এজেন্ডা নির্ধারণ করে আলোচনা শুরু করুন।
তিনি আরও বলেন, সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু উচ্চকক্ষের ভোট গ্রহণ কিভাবে হবে এবং উচ্চকক্ষের ক্ষমতা, কার্যপরিধি ও মর্যাদা কি হবে তা নিয়ে বিস্তারিত কোন সিদ্ধান্ত হয় নাই। নির্বাচনের আগে এইসব বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত হতে হবে।
মুফতী রেজউল করীম বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ইতিবাচক রাজনীতি করে। আমরা সবসময় সম্ভবনাকে বড় করে দেখি। আমরা নির্বাচনমুখি দল। নির্বাচনের জন্য আমাদের প্রস্তুতিও চলমান। আমরা আশা করি, সরকার আমাদের উদ্বেগ, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশাকে আমলে নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। জুলাই সনদ দ্রুত আলোর মুখ দেখবে। পিআর নিয়ে একটি যৌক্তিক সমাধান হবে। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধমে প্রত্যাশামাফিক আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জুলাই অভ্যুত্থান স্বার্থকতা পাবে।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ