মানুষ ‘খারাপ’ হয় কেন? জানুন বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা


‘সব মানুষ কি ভালো?’-এই প্রশ্নে কেউ বলেন, মানুষ মূলত ভালো, সমাজ তাকে খারাপ বানায়। আবার কেউ বলেন, ‘ভালো-মন্দ মিলিয়েই তো মানুষ।’ কিন্তু প্রকৃত অর্থে মানুষ কেন খারাপ হয়ে ওঠে? মানুষের মধ্যে কুপ্রবৃত্তি কেন জন্ম নেয়? মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও বিবর্তনবাদী তত্ত্ব একসঙ্গে খুঁজছে এই প্রশ্নের উত্তর।
জৈবিক গঠনে ‘খারাপ’-এর বীজ: বিজ্ঞান বলছে, আমাদের মস্তিষ্কের prefrontal cortex অংশটি নিয়ন্ত্রণ করে নৈতিকতা, আবেগ, সহানুভূতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ। গবেষণায় দেখা গেছে, অপরাধপ্রবণ বা সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিদের এই অংশটি তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয় থাকে। ফলে তারা অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারে না কিংবা ভুল করেও অনুশোচনা করে না।
এছাড়া কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য (genetic traits) মানুষকে আগ্রাসী বা সহিংস করে তুলতে পারে। অর্থাৎ, জন্মগতভাবেই কারও কারও মধ্যে খারাপ হওয়ার প্রবণতা থাকতে পারে-যদিও তা সবার ওপর সমানভাবে প্রভাব ফেলে না।
শৈশব ও পারিবারিক পরিবেশের প্রভাব: শৈশবের অভিজ্ঞতা আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। একটি শিশু যদি ভালোবাসা, স্নেহ ও নিরাপত্তার বদলে নির্যাতন, অবহেলা বা সহিংসতার মধ্যে বড় হয়, তবে তার মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বহু অপরাধীর শৈশব ছিল ভীতিকর, বঞ্চনামূলক বা অস্থির। ফলে তারা মানবিকতা শেখার সুযোগই পায়নি, বরং তাদের মনোজগতে গড়ে উঠেছে প্রতিহিংসা, আক্রোশ বা আত্মরক্ষামূলক সহিংসতা।
সমাজ কাঠামো ও পরিবেশের ছায়া: পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি এমনকি গণমাধ্যম-সব কিছুই একজন মানুষের চরিত্র গঠনে প্রভাব ফেলে। যদি কেউ এমন সমাজে বড় হয়, যেখানে প্রতিনিয়ত দুর্নীতি, সহিংসতা বা প্রতারণা হচ্ছে এবং তা কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না, তবে ভুলটাই তার কাছে ‘স্বাভাবিক’ মনে হতে পারে।
তেমনি দারিদ্র্য, বৈষম্য, বেকারত্ব ইত্যাদিও মানুষকে অপরাধের পথে ঠেলে দিতে পারে। তখন সে ‘ভালো’ হয়ে টিকে থাকতে পারে না বলেই, বাধ্য হয়ে খারাপের পথ বেছে নেয়।
বিবর্তনের ছায়া: কুপ্রবৃত্তি কি আদিম? বিবর্তনের ধারায় মানব মস্তিষ্কে কিছু প্রবৃত্তি তৈরি হয়েছে, যেমন: স্বার্থপরতা, আগ্রাসন, সন্দেহ ও প্রতিযোগিতা। প্রাগৈতিহাসিক যুগে এসব গুণ ছিল টিকে থাকার অস্ত্র। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই গুণগুলো এখন অনেক সময় নৈতিকতার পরিপন্থী হয়ে উঠেছে।
তবু মানুষের বিবর্তিত মস্তিষ্ক থেকেই জন্ম নিয়েছে সহানুভূতি, দয়া ও আত্মত্যাগ-সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপহার হিসেবে।
মানুষ খারাপ নাকি পরিস্থিতি খারাপ: এখানেই আসে সবচেয়ে জটিল প্রশ্নটি-মানুষ নিজের ইচ্ছায় খারাপ হয়, না কি সমাজ ও পরিস্থিতি তাকে খারাপ বানায়?
অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, মানুষ জন্মগতভাবে নিরপেক্ষ। তার পরিবেশ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও সুযোগই তাকে ভালো বা খারাপ করে তোলে। আবার কেউ বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ভালো-মন্দ দুই দিকই থাকে। কোনটি শক্তিশালী হবে, তা নির্ভর করে জীবন ও সমাজ কীভাবে তাকে গড়ে তোলে তার ওপর।’
শেষ কথা: মানুষ খারাপ নয়, জটিল মানুষ খারাপ হয়-এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই যে, প্রতিটি খারাপ মানুষের পেছনে থাকে একটি গল্প, একটি ব্যাখ্যা, এক বা একাধিক অব্যক্ত যন্ত্রণা। বিজ্ঞান বলছে, ‘খারাপ মানুষ’ বলে কিছু নেই, আছে জটিল মানুষ-যাদের আচরণের পেছনে কাজ করে জৈবিক, মানসিক ও সামাজিক বহুস্তরের প্রভাব।
তাই আমাদের উচিত কুপ্রবৃত্তির উৎস চিহ্নিত করে তা সারিয়ে তোলা, যাতে মানুষকে আর খারাপ হতে না হয়। কারণ কেউ যদি সত্যিকার অর্থে ভালো থাকার সুযোগ পায়, তবে সে সহজে খারাপের পথে পা রাখে না।
ভিওডি বাংলা/জা