• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীরা

বাণিজ্যিক যুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত

   ২ মে ২০২৫, ০৩:৪২ পি.এম.
ছবি: সংগৃহীত

ভিওডি বাংলা রিপোর্ট
দীর্ঘদিনের বাকযুদ্ধ শেষে এবার পাল্টাপাল্টি বাণিজ্যিক বিধিনিষেধে জড়িয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। দুই প্রতিবেশীর এমন পদক্ষেপে উদ্বেগে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের আশঙ্কা, এর জেরে দুই দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

গত মাসে বাংলাদেশ ভারতীয় তুলা সূতার স্থল আমদানি সীমিত করে স্থানীয় শিল্পকে সাশ্রয়ী বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে। জবাবে ভারত হঠাৎ করেই বাংলাদেশের জন্য চালু ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেয়। ভারতের ব্যাখ্যা বন্দর ও বিমানবন্দরে অতিরিক্ত চাপের কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এই দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয় গত আগস্টে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের দায়িত্বে রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থপাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। হাসিনা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ভারত এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো অবস্থান নেয়নি।

এদিকে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় ভারত প্রায়ই উদ্বেগ প্রকাশ করছে। সম্প্রতি একজন হিন্দু নেতা হত্যাকাণ্ডের পর ভারত দাবি করেছে, এটি সংখ্যালঘু নিপীড়নের ধারাবাহিক উদাহরণ। তবে বাংলাদেশের বক্তব্য, এসব ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা সাধারণ আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত অপরাধ; ধর্মীয় নিপীড়নের অংশ নয়। বাংলাদেশে ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের হার ১০ শতাংশের নিচে।

বাণিজ্যিক টানাপোড়েনের ফলে ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছেন দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত তুলা সুতা এখন আনা হচ্ছে সমুদ্র ও আকাশপথে, যা সময় ও খরচ—দুটিই বাড়িয়ে দিচ্ছে। ২০২৪ সালে ভারত বাংলাদেশে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের তুলা সুতা রপ্তানি করেছে, যার এক-তৃতীয়াংশ এসেছিল স্থলপথে।

ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা চালু থাকাকালে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক ভারতীয় ভূখণ্ড হয়ে এক সপ্তাহেই পৌঁছে যেত ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে। এখন তা সমুদ্রপথে পৌঁছাতে সময় লাগছে আট সপ্তাহ পর্যন্ত। এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান অনিস আহমেদ একে ‘‘ফাস্ট-ফ্যাশন রপ্তানির জন্য বড় ধাক্কা’ বলে মন্তব্য করেছেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আগামী সাত মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: প্রেস সচিববাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আগামী সাত মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: প্রেস সচিব
বিশ্বে চীনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ ২০২৪ সালে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যার এক বিলিয়ন ডলারের বেশি গিয়েছে ভারতীয় স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে। দেশের সীমিত কার্গো অবকাঠামো ও দুর্বল বিমানবন্দর সরাসরি রপ্তানিকে জটিল করে তুলেছে।

সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ড. ইউনূস মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ হলো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘একমাত্র সামুদ্রিক রক্ষক’ এবং ওই অঞ্চল ‘চীনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের ক্ষেত্র হতে পারে’। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেতারা এই বক্তব্যকে ‘‘আপত্তিকর’’ বলে অভিহিত করেছেন।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে মাত্র ২০ কিলোমিটার প্রশস্ত সিলিগুড়ি করিডর যাকে বলা হয় ‘চিকেনস নেক’ নেপাল ও বাংলাদেশের মাঝখানে অবস্থিত এবং তিব্বতের চুম্বি উপত্যকার খুব কাছেই। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে চীন এই করিডরকে টার্গেট করতে পারে।

বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনূসের বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাঁর মন্তব্যের মূল অর্থ ছিল আঞ্চলিক সংযোগের গুরুত্ব তুলে ধরা। একই সফরে বাংলাদেশ চীনের এক বিলিয়ন ডলারের তিস্তা প্রকল্পে আগ্রহ জানায় এবং সেটিকে স্বাগতও জানায়। কিন্তু ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকল্পটি সিলিগুড়ি করিডরের কাছাকাছি হওয়ায় এতে ভারতের কৌশলগত উদ্বেগ বাড়ছে।

ভারতের যেকোনো দুঃসাহসে কঠোর জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি পাক সেনাপ্রধানেরভারতের যেকোনো দুঃসাহসে কঠোর জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি পাক সেনাপ্রধানের
দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপরও। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। দৈনিক ভিসা অনুমোদনের হার কমে গেছে ৮০ শতাংশের বেশি। একসময় প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা ও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ভারত যেতেন।

ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান ও তাঁকে ফেরত পাঠানোর দাবিকে ঘিরে চলছে কূটনৈতিক টানাপোড়েন। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্যাম শরণ বলেন, ‘ভারত যদি হাসিনাকে হস্তান্তর করে, তাঁর কী পরিণতি হবে তা আমাদের জানা। ভারতীয় জনমতও সেটি মেনে নেবে না।’

এ অবস্থায় ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠন থেকে বাংলাদেশের পোশাক আমদানিতে স্থলপথে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার দাবি উঠেছে। ঢাকা থেকে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত যদি আরও বাণিজ্যিক বাধা তৈরি করে, সেটি হবে আত্মঘাতী। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতকে দেওয়া আগের সরকারের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাগুলো এখন বাংলাদেশে পুনর্মূল্যায়নের দাবি জোরাল হচ্ছে।’

বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নদীপথ, রেল ও সড়কযোগে পণ্য পরিবহন সুবিধা পায় দিল্লি। এতে পরিবহন খরচ ও সময় কমলেও বাণিজ্যের পরিমাণ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি।

এই অস্থির পরিস্থিতিতে আবার উঁকি দিচ্ছে এক নতুন কূটনৈতিক সম্ভাবনা। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান থেকে দূরত্ব বজায় রাখা বাংলাদেশ সম্প্রতি ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বার্তা দিয়েছে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত শীতল। তবে গত মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ ঢাকা সফর করেছেন—১৫ বছরের মধ্যে যা প্রথম। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সফরও নির্ধারিত ছিল, কিন্তু কাশ্মীরে প্রাণঘাতী হামলার জেরে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে তা স্থগিত হয়।

এই প্রসঙ্গে শ্যাম শরণ বলেন, ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে এ নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে যদি এটি ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি বা সমস্যা তৈরির কৌশল হয়, তাহলে তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়।’

এই কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জনমতও প্রভাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। ভারতের গণমাধ্যমকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও ইসলামি উগ্রবাদের খবর অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করার জন্য। দুই দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা সম্পর্কেও টান পড়তে শুরু করেছে। 

বিশ্লেষকদের সতর্কতা, উত্তেজনা না কমালে এর প্রতিক্রিয়া পড়বে সরাসরি অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ওপর।

তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা

ভিওডি বাংলা/ এমএইচপি

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করল তালেবান সরকার
বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করল তালেবান সরকার
যুক্তরাষ্ট্র সফরে ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর বৈঠকের সম্ভাবনা
যুক্তরাষ্ট্র সফরে ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর বৈঠকের সম্ভাবনা
পাকিস্তান সীমান্তে দুপক্ষের গোলাগুলি
পাকিস্তান সীমান্তে দুপক্ষের গোলাগুলি