সৈয়দপুরে পোল্ট্রি গবেষণায় নতুন দিগন্তের উম্মোচন


মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, গবাদি প্রাণীতে যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার মানবদেহের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ধরনের ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়ায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) এর আঞ্চলিক কেন্দ্র, সৈয়দপুরের উদ্বোধন ও কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
উপদেষ্টা বলেন, “মানুষ ও গবাদি প্রাণী পাশাপাশি বসবাস করে। তাই প্রাণিসম্পদে ক্ষতিকর কিছু ব্যবহার করা হলে তা মানুষের শরীরেও প্রভাব ফেলে। এজন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে।”
কর্মশালার বিএলআরআই মহাপরিচালক ড. শাকিলা ফারুক সভাপতিত্ব্ উপদেষ্টা আরও বলেন, দেশীয় জাতের মুরগি সংরক্ষণ এবং হাঁসের ডিমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, বাইরে থেকে খাদ্য উপাদান আমদানি করলে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএলআরআই এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজেদুল করিম সরকার। আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী এবং লালতীর লাইভস্টক লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক ড. কাজী ইমদাদুল হক।
এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসাবে সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, খাবারের দাম বাড়লে ডিম ও পোল্ট্রির দাম স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। তাই কম খরচে খাদ্য ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের কাজের ব্র্যান্ডিং জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। বিএলআরআই মহাপরিচালক ড. শাকিলা ফারুক বলেন, “মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের সাথে সাথে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বাড়ছে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণার বিকল্প নেই। বিএলআরআই দেশীয় সম্পদ সংরক্ষণ এবং উৎপাদন খরচ কমাতে কাজ করে যাচ্ছে। এর আগে উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর শহরের রংপুর সড়কস্থ বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্পের অর্থায়নে স্থাপিত সৈয়দপুর আঞ্চলিক কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। ফিতা কেটে ও নামফলক উন্মোচনের মাধ্যমে উদ্বোধনের পাশাপাশি তিনি বৃক্ষরোপণ করেন এবং কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করেন। এ সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের, অতিরিক্ত সচিব নীলুফা আক্তার, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবু সুফিয়ান, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, সৈয়দপুরে বিএলআরআই আঞ্চলিক কেন্দ্রটি পোল্ট্রি গবেষণায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচন করেছে। দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। জাতীয় কৃষি গবেষণা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণে কাজ করবে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে অঞ্চলভিত্তিক প্রাণিসম্পদ সমস্যাও ভিন্ন। তাই এসব সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের লক্ষ্যে বিএলআরআই বিভিন্ন আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন করছে। এরই অংশ হিসেবে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের খামারি, উদ্যোক্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকদের চাহিদা বিবেচনায় সৈয়দপুরে আঞ্চলিক কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের রংপুর মহাসড়কস্থ এলাকায় প্রায় ৮ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। “পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ” প্রকল্পের অর্থায়নে ২০২০-২১ অর্থবছরে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়। বিশাল এর ক্যাম্পাস দৃষ্টিনন্দন সীমানা প্রাচীরে ঘেরা প্রধান ফটক। এর অভ্যন্তরে অফিস কাম ল্যাবরেটরি ভবন, পোল্ট্রির ব্রুডার, গ্রোয়ার ও লেয়ার শেড, আরসিসি কার্পেটিং রোড, বায়োগ্যাস প্লান্ট, ১৫০ কেভিএ সাবস্টেশন ও সোলার সিস্টেম রয়েছে। বর্তমানে এখানে বর্তমানে প্রায় ১৯০০ পাখি সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে আছে ৪টি উন্নত বিদেশি জাত (হোয়াইট লেগহর্ন, রোড আইল্যান্ড রেড, হোয়াইট রক, ব্যারেড প্লাইমাউথ রক) এবং ২ ভ্যারাইটি রাজহাঁস (হোয়াইট ও গ্রে)। প্রকল্পভুক্ত এমএস ও পিএইচডি ফেলো গবেষকরা গবেষণা পরিচালনা করছেন। এ পর্যন্ত ১৮ ব্যাচে প্রায় ৩৫০০ খামারি বা উদ্যোক্তা প্রশিক্ষিত হয়েছেন। এর চলমান গবেষণায় উন্নত বিদেশি জাতের ৪টি পিউর লাইন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন। রাজহাঁস সংরক্ষণ ও ফরেজভিত্তিক খাদ্য ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন প্যাকেজ উদ্ভাবন। কমিউনিটিভিত্তিক খামারিদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ। শাকসবজি সমৃদ্ধ মুরগির কাটলেট ও কাবাব প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন। গবেষণালব্ধ প্রযুক্তির মাঠ পর্যায়ে প্রাথমিক ভ্যালিডেশন।
তাই সম্ভাবনাময় এ কেন্দ্রটি পোল্ট্রির বিভিন্ন প্রজাতি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, অধিক মাংস ও ডিম উৎপাদনশীল জাত উদ্ভাবন, খামারিদের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও প্রশিক্ষণ, নতুন নতুন গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে।
সর্বপরি সৈয়দপুর আঞ্চলিক কেন্দ্র শুধু উত্তরাঞ্চলের জন্য নয়, গোটা দেশের প্রাণিসম্পদ গবেষণার এক নতুন মাইলফলক। আধুনিক অবকাঠামো, বিশেষায়িত গবেষণা ও খামারি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এটি খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ