ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় অর্ধশত যুবককে নির্যাতন, মুক্তিপণ দাবি


ভাল বেতন হবে, জীবন হবে উন্নত। কিন্তু একটু কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৩ ঘণ্টায় পানি পথে ইতালি পৌঁছাতে হবে। এমন আশ্বাস দেন মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া গ্রামের আলাই কারিগরের ছেলে জামাল কারিগর।
লিবিয়া নিয়ে যুবকদের হাত-পা বেঁধে মুক্তিপণের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত সিনেমা স্টাইলে চলে নির্যাতন। সেই নির্যাতনের ভিডিও দেখানো হয় পরিবারকে।
শারীরিক নির্যাতনের সেই দৃশ্য দেখে ভেঙে পড়ছে পরিবারগুলো। নির্যাতনে কেউ প্রাণ হারায়, নির্যাতনের ফলে কারো কারো ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে পোকায় ধরে। এরপর দালালের মুক্তিপণের টাকা দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। প্রতিকার চেয়ে মামলা করলে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। উল্টো মিথ্যা মামলা দেওয়া হয় ভুক্তভোগীদের নামে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলা শিরখাড়া ইউনিয়নের ঘুনসি গ্রামের হাসান হাওলাদার, মাদারীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ২০২২ সালে ভাগ্য বদলের আশায় ১৩ লাখ টাকায় স্পন্সর ভিসায় ইতালি যাওয়ার চুক্তি হয় একই এলাকার দালাল জামাল কারিগরের সাথে।
হাসান হাওলাদারকে প্রথমে দুবাই পরে লিবিয়ায় নিয়ে বিক্রি করে দেয় মাফিয়ার কাছে। পরে আরো ৫ লাখ টাকার জন্য চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। বর্তমানে পরিবারের সাথে যোগাযোগ নেই। একই গ্রামের রুহুল শেখ মারা গেছে দালাল চক্রের নির্যাতনে।
এই গ্রামের মিন্টু হাওলাদার প্রায় ১৮ মাস আগে ইতালি যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়েন। টাকার জন্য তাকেও করা হয় অমানবিক নির্যাতন। মিন্টু হাওলাদারকে জীবিত উদ্ধারের জন্য দালাল চক্রকে ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছে তার পরিবার।
এদিকে মিঠু দাসকেও একই দালালের কাছে জিম্মি দশায় গুনতে হয়েছে মোটা অংকের টাকা। এই দালাল ছাড়েনি বৃদ্ধ শাহ আলমকেও।
শুধু হাসান হাওলাদার, মিন্টু হাওলাদার, মিঠু দাস, শাহ আলম নয়। অবৈধপথে ইতালি যাবার সময় লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে জিম্মি মাদারীপুরের শিরখাড়া এলাকার অর্ধশত যুবক।
দালাল জামাল কারিগর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ট হওয়ায় কেউ কিছু বলার সাহস পেতো না। মামলা করে অনেক ভুক্তভোগী উল্টো জেল খেটেছে। এই দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।
স্থানীয়দের দাবি, মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া গ্রামের আলাই কারিগরের ছেলে জামাল কারিগর দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচারের ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছে। ইউরোপে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে অর্ধশতাধিক যুবককে লিবিয়ায় পাঠিয়ে সেখানে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের পরিবারের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করছে এই চক্র।
জানা গেছে, জামাল কারিগর ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাদারীপুর সদরসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের যুবকদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রথমে লিবিয়ায় পাঠান। পরে সেখানকার তথাকথিত ‘গেমঘরে’ আটকে রেখে চালানো হয় চরম নির্যাতন। নির্যাতনের ছবি, ভিডিও ও ভয়েস রেকর্ড পাঠিয়ে স্বজনদের কাছে টাকা দাবি করা হয়। পরিবার থেকে টাকা না এলে চলে আরও নির্যাতন।
ঘুনসি গ্রামের হায়দার হাওলাদারের ছেলে হাসান হাওলাদার তেমনই নির্যাতনের শিকার। তার বাবা হায়দার হাওলাদার বলেন, ‘আমার ছেলেকে লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতন করে ১৫ লাখ টাকা আদায় করেছে। আমি মামলা করেছিলাম, কিন্তু জামাল উল্টো আমার বিরুদ্ধেই মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। আমাকে জেলও খাটতে হয়েছে।’
উত্তর শিরখাড়া গ্রামের মিন্টু হালদারসহ আরও অনেকে একইভাবে প্রতারিত হয়েছেন। কয়েক বছর আগে রুহুল আমিন শেখ নামের এক যুবক এই চক্রের নির্যাতনে প্রাণ হারান। কিন্তু সেই মামলার বিচার আজও হয়নি।
ভুক্তভোগী শাহ আলম মাতুব্বর বলেন, ‘জামাল ইতালি পাঠানোর কথা বলে ১২ লাখ টাকা নেয়। পরে লিবিয়ার মরুভূমিতে আটকে রেখে তার লোকজন আমাকে চাবুক দিয়ে পেটায়। আমি এর কঠোর বিচার চাই।’
ভুক্তভোগী হাসান হাওলাদারের মা রিনা বেগম বলেন, ভিটে-মাটি বিক্রি করে টাকা দিয়েও মিলছে না মুক্তি। আমরা দালাল জামালের বিচার চাই।
আরেক ভুক্তভোগী মিন্টু হাওলাদারের মা সাবিনা বেগম বলেন, দালাল জামাল কারিগর আমার ছেলেকে লিবিয়ায় মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। শুধু আমার ছেলেকে নয়, এমন শতে শতে ছেলেদের জীবন ধ্বংস করেছে। জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
এদিকে দালাল জামাল কারিগর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। আমার ছেলেকেই আমি অনেক টাকা খরচ করে ইতালি পাঠিয়েছে। আমি কাউকে হুমকি-ধামকিও দেইনি। আমি একজন ব্যবসায়ী মানুষ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জামাল কারিগরের বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদরসহ বিভিন্ন থানায় অন্তত ১০টির বেশি মামলা রয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সে জামিনে বেরিয়ে এসে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ভুক্তভোগীদের ও সাক্ষীদের ভয় দেখিয়ে উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর সাহা বলেন, দালালদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। দালালদের ভয়ভীতি দেখানো সুযোগ নেই।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে দালালদের তালিকা করা হয়েছে। দালালদের এই তালিকা জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে টানিয়ে দেওয়া হবে। অপরাধ জগতের ভয়ঙ্কর এ অধ্যায় বন্ধ করতে হলে জামালের মতো চক্রগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
ভিওডি বাংলা/এস এম রাসেল/এম